কাজের ফাঁকে ফাঁকে মেয়েটি একটি চিঠি লিখছে কিন্তু আজও সে ঠিক করতে পারেনি কাকে চিঠিটা পাঠাবে। তবু, প্রতিদিন কারও না কারও নাম মনে করে যতটা লেখা হয়েছে পড়ে, আজও পড়ছে-
যখন ফাইভ-সিক্সে পড়ি তখন জন্মদিনে বাবা একবার ঈশপের গল্প আর-একবার জাতকের গল্প উপহার দিয়েছিলন। কিন্তু কোনও বইয়েরই দু’তিনটের বেশি গল্প পড়া হয়নি। এটা জেনে বাবা দুঃখ পেতন। আমি যুক্তি দেখাতাম, পড়াশুনোর চাপ। বাবা খুব নরমভাবে বলতেন, এখনও মনে আছে, বলতেন ‘একটা গল্প পড়তে কত সময়? খুব বেশি হলে এক ঘন্টা! দশ মিনিট কার্টুন দেখা অফ করলে, সপ্তাহে একটা গল্প তো পড়া যায়! এই চাপটা নেয়া যায় কি না ভেবে দেখতে পারো!’ এটা বলার পর আর কোনও কথা হত না। অনেকদিন পরে পরে খোঁজ নিলে বলতাম, একটা-দুটো পড়েছি। বাবা বোধহয় বুঝতে পারতেন, আমি মিথ্যে বলছি। তবে হ্যাঁ, একটাও যে পড়িনি, তা নয়। সম্ভবত, ঠিক মনে নেই, সেভেন থেকেই হবে, জন্মদিনে মাথায় ধানদুব্বো দেওয়ার সময়, সকলের দেওয়া হয়ে গেলে বাবা বলতেন, ‘এই কেউ চলে যেও না, ছোট্ট একটা গল্প বলব, শোনো!’ সেই ট্র্যাডিশনটা এখনও আছে। ভেবে দেখেছি গত আট-নয় বছরে বলা গল্পগুলো খুব একটা মনে নেই, কেবল একটি গল্প মাঝেমধ্যে মনে পড়ে আর আশ্চর্য এই যে, বাবা পুরো ‘গল্প’টা বলেছিলেন চোখ বন্ধ করে, আমি সেই মূর্তিটা দেখতে পাই, প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে, যেন চলচ্চিত্র, বাবা বলছেন, ‘এটা ঠিক গল্প নয়, ফ্যাক্ট; আমার এক বন্ধুর জীবনের ঘটনা; তোমরা তাকে দ্যাখনি। আমাদের বিয়ের সময় এসেছিল। সে একবারই, তোমার মনে থাকার কথা নয়। তার মেয়ে, ক্লাস টেনে ভর্তি হওয়ার আগেই, একটি হৃদয় বিদারক চিঠি লিখে একটি ‘উদ্বাস্তু’ ছেলের সঙ্গে বাড়ি ছাড়ে। আমার সঙ্গে সে ফোনে কথা বলে। আমি তাকে পুলিশকে জানানোর কথা বলি। সে বলে, পুলিশ হয়তো খুঁজেপেতে মেয়েকে ফিরিয়ে দেবে কিন্তু এতটা বয়েস পর্যন্ত যে তার কাছে থাকল, তাকে তো তারা ধরে রাখতে পারেনি! আর-কি ধরে রাখতে পারবে? আমার চুপ থাকতে দেখে সে বলেছিল, চিন্তা করিস না, জীবনের নিরন্তর বিকাশের এ একটা পর্যায়, জৈব পর্যায়— এটা পাশব অবস্থা। এই অবস্থা থেকে মানবিক পর্যায়ে পৌঁছানোর পথ কাটতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। কীভাবে সামলানো যাবে— ভাবছি; ডোন্ট ও’রি! এক বছরের মাথায় মেয়ে মা হল। আর আট-ন’ বছর পর সন্তান নিয়ে মেয়ে ফিরে এল বাপের কাছে। এখন মেয়ে আর নাতনির খোঁজ নিলে বন্ধু বলে, কোনও গল্প নেই। কোনও গল্প আমিও তৈরি করতে পারছি না।’ বলে তিনি চোখ খুলে বললেন, ‘এই!’ যেন আকাশ দেখতে চেয়ে তিনি দীর্ঘশ্বাস আটকে রেখেছিলেন। আর কেন জানি না, খেয়াল করে দেখেছি মা আমার দিকে অপলকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর চোখে জিজ্ঞাসা।
একদিন আবিষ্কার করলাম, এক বিশেষ মুহূর্তে এই গল্পটা মনে পড়ে। এখন সেই ‘মুহূর্ত’ চলছে। আর তোমাকে লিখছি। আমার বাবা কথা বলার সুযোগ পেলেই, এক কথায় তত্ত্বকথা বলতেন, এখনও বলেন, তবে কমে গেছে। সেই সব কথা থেকে কেমন যেন একটা বোধ তৈরি হয়েছে। যেমন ধরো, একটা কুকুরের সঙ্গে আমার বেঁচে থাকার ফারাকটা কোথায়— এটা যদি তুমি খুঁজতে চাও, তবে তুমি মিল আছে— এটা-কিন্তু স্বীকার করে নিয়েছ! একথা-কিন্তু তোমাকে বলছি না, নিজেকে যেমন বলি, সেটাই বললাম তোমাকে। এর পরের কথাটাই মারাত্মক। মিল কোথায়, সেটাই জানো না! আচ্ছা, তুমি কি জানো? আচ্ছা, তোমাকে একটা কথা বলি, আমার মনে হয়, বাবার মাথাটা বিগড়ে যাচ্ছে, নইলে এরকম কেউ বলতে পারে, যদি নিজেকে জানতে চাও তবে কুকুরকে স্টাডি করো!
যদি ধরে নিই একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ ওরকম ভাবতে পারে না, তাহলে আমার কেন মনে হয় আমার মধ্যে কুকুর-স্বভাব আছে। কী করে বুঝলাম, মানে ঘটনাটা— বললে তুমি বুঝতে পারবে। তখন থার্ড ইয়ার। আমাদের পাঁচ-ছ’ জনের একটা গ্রুপ ছিল। গ্রুপের একটি ছেলেকে দেখতে দেখতে তাকে কেমন এক দুর্বল ভীতু কুকুর হয়ে যেতে দেখতাম। আবার একটি মেয়ে, তাকে কেমন যেন খেঁকি হয়ে যেতে দেখতাম। আর এর ফলে যেটা হত আয়নায় নিজের মুখকে কুকুরের মুখ হয়ে যেতে দেখতাম।
যাই হোক এই যে বিশেষ ‘মুহূর্ত’ চলছে, আমার মনে পড়ছে সেই মেয়েটির কথা, ঠিকভাবে বললে, ভাবছি মেয়েটির বাবার কথা, জীবনের নিরন্তর বিকাশ— আমি এখন কোন পর্যায়ে? খুব অনেস্টলি বলছি, কাল তোমাকে আমি স্বপ্নে দেখেছি, নীল স্বপ্ন। কিন্তু আজ গণতন্ত্রের দাবীতে যে র্যালি ছিল, আমি তোমাকে সেখানে খুঁজেছি। খুব মন খারাপ হয়ে গেল। স্বপ্নে আছ, রিয়েলিটিতে নেই! কল্পনায় দেখি তুমি আমার সামনে। জিগ্যেস করলাম, তুমি কি গণতন্ত্র চাও না? তুমি বললে, না। আর আমার মনে পড়ল, একদিন কথায় কথায় তুমি বলেছিলে, এখনও বসুন্ধরা বীরভোগ্যা! শক্তপোক্ত কাঠিন্যে ভরা তোমার মুখটাও মনে করতে পারলাম। আমি বোধহয় থেমে ছিলাম। যেন কোথাও ভুল হয়ে গেছে। অসহায় লাগছিল… কেউ একজন আমাকে গতি দিল। নিজের অজান্তেই যেন তখনকার স্লোগানে ধুয়ো দিয়ে উঠলাম, বন্ধ করো, বন্ধ করো! এখন মনে করতে পারছি, স্লোগান ছিল দৃষ্টিহরণ আর হত্যার বিরুদ্ধে। আর তখনি আমাকে গতি দেওয়া ছেলেটিকে দেখলাম। সে আমাদের গ্রুপের সেই ছেলে… লাইন ঠিক রাখার কাজ করছে। ব্যস্ত রাস্তা, যতটা সম্ভব মানুষের যাতায়াত স্বাভাবিক রেখে, মিছিলের মানুষের নিরাপত্তার কথা ভেবে কাজটার গুরুত্ব আছে বলে মনে হল। আর যেটা ঘটল, আমার চেনা ছেলেটি কেমন অচেনা হয়ে গেল। মিছিল সামল দিতে দিতে সে কখনো দূরে সরে যাচ্ছিল, একবার নিকটে আসতেই ‘অচেনা’ ছেলেটিকে আমি চোখে চোখে রাখছিলাম, চোখাচোখি হতেই, পরে ভেবে দেখেছি, আমি আমার জীবনের সব চেয়ে সুন্দর হাসিটি হাসলাম; তার অস্ফুট হাসিমাখা চোখ যেন প্রত্যুত্তর দিল— এই মুহূর্তে দৃশ্যটা ফিরে দেখতে গিয়ে দেখছি, এক আশ্চর্য মুদ্রায় তার ডান হাত আমার দিকে উঠেছে…
মিছিল শেষে, তখন বক্তব্য রাখা হচ্ছিল। আমাদের দেখা হল। আমরা যে পরস্পরকে খুঁজছিলাম, দেখা হওয়ার মুহূর্তেই সেটা বুঝতে পারলাম। আমার খুব ইচ্ছে করছিল একান্তে কোথাও বসতে। ছেলেটি যেন আমার মনের কথা জেনে বলল, ‘আমরা ওইখানটায় বসতে পারি!’ আমরা বসলাম। আমাদের গ্রুপের ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে বসেছি, গা ঘেঁষাঘেঁষি করে কারও সঙ্গে বসাও হয়েছে কিন্তু তার সঙ্গে কখনও এত কাছে বসা হয়নি।
আমরা পরস্পরকে দেখছিলাম। দেখতে দেখতে ছেলেটি বলে উঠল, ‘এই গণতন্ত্র দিবস— আমার জীবনের ক্যালেন্ডারে একটি বিশেষ দিন হয়ে উঠল।’ আমি বলে উঠলাম, ‘আমারও!’ তারপর কি-ভেবে আমি তার কাছে একটা গল্প শুনতে চাইলাম। যে কোনও গল্প। যেন তাকে সমস্যায় ফেলেছি। বললাম, ‘তুমি বোধ হয় গল্প জানো না! থাক!’
সে বলল, ‘না তা নয়, ভাবছিলাম, কী গল্প শোনাবো! শোনো তবে!’ বলে সে যে গল্পটা বলেছিল, সেটা তোমাকে লিখছি।
এক দেশে ঈশ্বরবিশ্বাসী এক মানুষ ছিলেন। তিনি আশ্চর্য এক বেঁচে থাকার পথ উদ্ভাবন করেছিলেন। তাঁর মত প্রচার করে বেড়াতেন। মূলত অহিংসা আর ক্ষমার সেই পথে শত্রুর অভাব হল না। নানা ভাবে তাঁকে, আজকের ভাষায় ফাঁদে ফেলার চেষ্টা হল। একবার ব্যভিচারের অভিযোগ এনে এক মহিলাকে তাঁর কাছে আনা হল বিচারের জন্য। তখন শাস্ত্রমতে ব্যভিচারের শাস্তি পাথর ছুড়ে মেরে ফেলা। অভিযোগকারীরা এটাই চায়। বুঝতে পেরে মানুষটি বললেন, ‘তাই হবে। তবে পাপ যাকে এখনও স্পর্শ করেনি, তিনিই প্রথম পাথরটি ছুড়বেন!’ দেখা গেল, একসময় সেই মহিলা ছাড়া, সেখানে আর কেউ নেই। তিনি মহিলাকে বললেন, ‘আমি তোমাকে দোষ দিচ্ছি না। তুমিও যাও! তবে আর পাপ করো না!’
তখন সন্ধ্যা নামছে। আমার দৃষ্টি ঝাপসা। উপরের আকাশ থেকে রঙিন মেঘ আলো ছড়াচ্ছিল। সেই আলোর মায়ায়, নাকি আমার অশ্রুবাষ্পের কারসাজিতে, কে জানে, ছেলেটি আশ্চর্য এক শিহরণ জাগালো… যা দেখলাম তা অতুলনীয় নয়, বুঝতে পারছিলাম কিন্তু তুলনা খুঁজে পাইনি— আজ আয়নায় নিজের মুখ দেখতে দেখতে মনে হল
মনে হওয়াটা আর লিখল না। পুরো লেখাটা একবার পড়ল। তারপর ‘সিলেক্ট’ করল। কী যেন ভাবল। তার তর্জনী ডীলীট বাটম ছুঁয়েছে। চাপ। স্ক্রিন সাদা হয়ে গেল।
—
পরিচিতি: জন্ম ৭অঘ্রায়ণ ১৩৬২ বনগাঁর কাছে মণ্ডলপাড়া গ্রামে। প্রথাগত শিক্ষা- বি.এ। ঘোষিতভাবেই লিটিল ম্যাগের লেখক। এবং মানবাধিকারকর্মী। সরকারী চাকরীজীবি ছিলেন। প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে গল্প সংকলন- নীলরতন (১৯৯২), জ্যোৎস্নায় হাঁটা ও আরো কিছু গল্প (‘৯৫), কাফেস (‘৯৯), মুদ্রারাক্ষস (২০০২), অদৃশ্য সম্পরকগুলি (২০০৮), নির্বাচিত পঞ্চাশটি গল্প (২০১৫)।উপন্যাস- উত্তর হাওয়ার গান( ১৯৯৭), ঈশ্বরের বিরুদ্ধে আবহমান (২০০৪), সোনালি ডানার চিল (২০০৯), চা-মাটির সাতকহন (২০১৭)। প্রবন্ধ সংকলন- রাষ্ট্রের দৃষ্টি কবির দরশন (২০০৬), নারীপুরুষের যৌথ অভিযান মানবিক সমাজের দিকে (২০১০), মানবিক রাজনীতির ধারণা (২০১৩), মানবাধিকার-রাজনীতি (২০১৭), ভয়তাড়িত সমাজ (২০১৯)। প্রকাশিতব্য- শিল্প সাহিত্যের ভাবনাসুত্র: অন্য দৃষ্টিকোণ। উপন্যাস ও প্রবন্ধ গ্রন্থের প্রকাশক ‘উবুদশ’। গল্পগ্রন্থের প্রথম দুটির প্রকাশক ‘অন্যধারা’ আর ৫মটি ‘দীপ প্রকাশন’ আর ৩টি ‘উবুদশ’।