এক।।
টুং করে শব্দ হতেই ফোনটা হাতে নেয় ইলোরা। ওর ছোটবোন দিনভর মেসেঞ্জারে নানারকম লিংক পাঠায় ওকে। ইলোরা সকালে দেখেছে ফেসবুকে একটা বাচ্চা মেয়ের গানের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। বোনের দেয়া লিংকটায় ক্লিক করতেই সেই মেয়েটা মাথা দুলিয়ে ভীষণ সুরে গাইতে শুরু করলো। ‘যখন থামবে কোলাহল,ঘুমে নিঝুম চারিদিক।’
ইলোরার এখানেও সবাই নিঝুম ঘুমে আচ্ছন্ন। বেড়াল ছানার মতো ওর গা ঘেঁষে ঘুমাচ্ছে বিন্তি। প্রেজেন্টেশনের ফাইল গুছিয়ে শাফিনও খুব ক্লান্ত ছিল। বিছানায় শুতে না শুতেই ওর নাক ডাকার শব্দ পাওয়া গেছে। ওদের পাশে শুয়ে নীল রঙের জগৎটায় ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে ঘুম এলো ইলোরার।
ওর আজকাল ফেসবুক আর ভালো লাগে না। সবাই দিনরাত হাসিখুশি মুখ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এত সুখী সুখী গল্প শুনে ক্লান্ত সে। তবুও বাজে নেশাটা ছাড়তে পারছে না। বেখেয়ালে ঠিকই ফোনের কাছে হাত চলে যায়। এসব নিয়ে শাফিনের অনুযোগের শেষ নেই। অথচ সব কাজ শেষ করে দুপুরে বাড়ি ফিরে ইলোরারও ইচ্ছে করে বন্ধুদের সাথে একটু আধটু গল্প করতে। বিকেলে মেয়ের স্কুলের পড়া, নিজের কলেজের লেকচার তৈরি করার সময় আরেক হাতে রান্নাটাও সারতে হয়। এতসব করে হাঁপিয়ে যায় সে ৷ এসবের মাঝেই বন্ধুদের গ্রুপচ্যাটে আড্ডা দিলে কিংবা ইউটিউবে গান শুনলে মাথাটা একটু হালকা হয়। মাঝেমাঝে বিরক্তিও লাগে। ইলোরা লক্ষ্য করেছে ওর এই আসক্তি প্রায় প্রতিদিনই অনেকটা সময় নষ্ট করে দিচ্ছে। এখন থেকে শুধু দরকারি আলাপ ছাড়া মোবাইল আর হাতেই নেবে না বলে ঠিক করেছে সে।
বিন্তি বড় হচ্ছে, ওকে সময় দেয়া দরকার। স্কুলের পড়া পড়তে চায় না মেয়েটা। শুধু গল্প শুনবে আর কার্টুন দেখবে। গ্রামের দৃশ্য আঁকতে বসে এঁকে রাখবে মিকি মাউস নয়তো মোয়ানা। এসব তো সিলেবাসে নেই। ওদের লিটল বার্ড স্কুলে পড়াশোনার খুব একটা চাপ না থাকলেও বিন্তির বন্ধুরা এরই মধ্যে অনেক কিছু শিখে ফেলেছে। সেদিন আরিয়ানের মা খুব বড় মুখ করে বলছিল তার ছেলের নাকি ‘বীরপুরুষ’ কবিতাটা ঠোঁটস্থ মুখস্থ । একবার বলতেই আরিয়ান পুরো কবিতাটা নির্ভুলভাবে আবৃত্তি করে শোনালো। সবাই হাঁ করে শুনছিল। তারপর ইষ্টির মা জানালো ইষ্টি নদীর দৃশ্য আঁকতে শিখেছে। সবাই দেখতে চাইলে অমনি ওর ড্রয়িং খাতাটা খুলে দেখিয়ে দিল। এসব দেখে শুনে ইলোরার মন খারাপ হয়ে যায়। সে একটু পর ওখান থেকে উঠে পড়ে।
বিন্তিকে ওর বন্ধুদের পাশে কেমন নিষ্প্রভ মনে হয়। ইষ্টি,টুসী,অংশুদের মতো বিন্তির তেমন কোনো গুণ নেই। এমনকি ছোট ছোট রাইমসগুলোও সে মনে রাখতে পারেনা। শাফিনকে বললে সে পাত্তাই দেয় না। বলে – ‘এত টেনশন কোরো না। পিয়ার প্রেশার যত নেবে ততই পেয়ে বসবে তোমাকে!
এসব প্রেশার ইলোরা বোঝে না, এত ছোট বয়সে মেয়েকে সব বিদ্যায় পারদর্শী করার ইচ্ছেও তার নেই। কিন্তু সত্যিই বিন্তিটা কিছু মনে রাখতে পারে না। মুখে মুখে বানান বলে ফেললেও লিখতে গেলে সি এর মাথা ঘুরে যায়, ডাব্লিউ হয়ে যায় এম। এগারোর পর বারো হয়ে যায় বেগারো। শাফিন মেয়ের কান্ডকীর্তি দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ে। ওদিকে স্কুলে টিচারের সাথে দেখা করার বেলায় ইলোরাকেই কাঁচুমাচু মুখে হাজির হতে হয়। প্রেশার না নিয়ে পারা যায়?
সামনের সপ্তায় স্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, তার প্রস্তুতি চলছে। ইষ্টি আর টুসী নাচবে, অংশু গান গাইবে। সবাই কিছু না কিছু করবে। বিন্তি কী করবে জানতে চাইলে সে দৌড়ে পালিয়ে যায়। সে নাকি শুধু দেখবে। শাফিন শুনে বলেছে- দর্শকের ভূমিকাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাবা মেয়ের কথা শুনে ইলোরার রাগে দুঃখে কান্না পায়। তবু সে মেয়েকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করাতে চেষ্টা করে।
:বিন্তি যখন ‘ও সোনাব্যাঙ’ গানটা গাইবে আমরা সবাই তখন বলবো ‘বাহ বাহ ভেরি গুড’!
:কিন্তু আমি তো এই গানটা পারি না মা!
:ভুলে গেলি? তুই তো পারিস এটা।
বিন্তি বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে তাকায়। যেন কখনো শোনেইনি এই গান। গালে হাত দিয়ে কিছু একটা ভাবে। তারপর ফিক করে হেসে ফেলে বলে- এখন মনে পড়েছে, আমি ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে’ গানটা করবো।
: আচ্ছা বাবা ওটাই করিস তাহলে। এখন একবার শোনাবি আমাকে?
: উঃ মা আমি তো এখন ব্যস্ত…পরে শোনাবো।
বলেই টেডি পুতুলটা নিয়ে ঘর থেকে পালিয়ে যায় বিন্তি। সত্যি এই মেয়েকে দিয়ে কিছুই হবে না! ইলোরা হাল ছেড়ে দেয়। অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে ফেসবুকে স্ক্রল করতে থাকে। সেই বাচ্চা মেয়েটার আরেকটা ভিডিও শেয়ার করেছে ওর এক বন্ধু। ইলোরা আজকে সাথে সাথে তাকে আনফলো করলো। প্রতিদিন এক জিনিস! খেয়েদেয়ে কাজ নেই মানুষের। বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে যায় ওর।
দুই।।
শাফিন ফোন ধরছে না। একবার দুইবার তিনবার ফোন রিং হয়ে থেমে গেছে। ইলোরার চোখে জল। ব্যাপারটা এখুনিই ওকে না জানালে মনটা শান্ত হবে না। শাফিন হয়তো জরুরি মিটিংয়ে আছে তাই ফোন ধরেনি। তখুনিই ওকে মেসেঞ্জারে টোকা দেয় কেউ। ইলোরা মোবাইলটা হাতে নেয় আবার। শাফিন!
:কোনো সমস্যা? জ্বর কত এখন?
:এখন নেই। তুমি কি ব্যস্ত?
:হুম।
:তাহলে কাজ শেষ হলে কথা বোলো।
বিন্তির আর জ্বর আসেনি। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে ভুগছে মেয়েটা। গতকাল দুপুরের পর একটু বিছানায় উঠে বসেছে। আরো ছোট্ট দেখাচ্ছে ওকে। জ্বর একশো একের বেশি হলেই ওর খিঁচুনি হয়। শাফিন আর ইলোরা তখন আতঙ্কে কাঠ হয়ে বসে থাকে ওর পাশে। ডাক্তার দেখানো হয়েছে বহুবার। কড়া ওষুধ খেতে হয় বিন্তিকে। শুরুর দিকে তপ্তশরীরটা যখন কেঁপে কেঁপে উঠতো ইলোরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়তো। ইদানিং জ্বর আর খিঁচুনির ধরণটা ওরা বুঝতে পেরেছে। ঠিক সময়ে ওষুধ খাইয়ে দিলে খিঁচুনি আর হয় না।
ইলোরা জ্বরের কথা জানাতে ফোন করেনি। বিন্তি অদ্ভুত কিছু কথা বলেছে আজ, সেটাই জানাতে চাইছিলো ওর বাবাকে।
সকালে নাস্তা করে মা মেয়ে শুয়ে শুয়ে গল্প করছিল। মেয়ে হঠাৎ বললো – আচ্ছা মা এই যে আমার কিছু মনে থাকে না তার জন্য তুমি কি রাগ করো?
:না রে আমি রাগ করি না।
:কষ্ট পাও?
:না তো কষ্ট পাইনা।
:অংশু সব রাইমস পারে। আমি কেন ভুলে যাই! আর ইষ্টি কী সুন্দর আঁকে..
:তুইও চেষ্টা করলে সব পারবি। এসব তো খুব সহজ!
: আমি সব ভুলে যাই কেন মা?
কথাগুলো জড়িয়ে যায়, ফোঁপাতে শুরু করে বিন্তি। ওর কান্না দেখে ইলোরা ভীষণ অবাক হয়ে যায়। মেয়েটা সবই বোঝে, ওর ভেতরেও চাপাকষ্ট আছে! মেয়েকে বুকের ভেতর টেনে নিয়ে ইলোরাও অঝোরে কাঁদতে থাকে।
: মা, তুমি কেঁদো না। তুমি কাঁদলে আমার কষ্ট হয়।
মায়ের চোখ মুছে দেয় বিন্তি। তারপর বলে- আমি একটু ছবি আঁকবো।
সাথে সাথে রংপেন্সিল আর খাতা এগিয়ে দেয় ইলোরা। আজ মেয়ের সবকিছুতে সে হ্যাঁ বলবে। বিন্তি গম্ভীর মুখে ছবি আঁকে, মা পাশে বসে থাকে।
শাফিনকে মেসেজের উত্তর দিয়ে একটু পর ইলোরা রান্নাঘরের দিকে যায়। প্রথম দু’দিন শাফিন অফিস কামাই করে মেয়ের কাছে থেকেছে। আজকে ইলোরা বাসায়, সেও কলেজ থেকে তিনদিন ছুটি নিয়েছে।
আজ পোলাও রান্না করবে ইলোরা। মেয়েটা কতদিন ঠিক মতো খায়নি। গত সপ্তাহে কেনা গলদা চিংড়ি রয়ে গেছে ফ্রিজে। ফ্রাই করলে বিন্তি ভালোবেসে খায়। আর মিষ্টিকুমড়ো ভাজা, পেঁপে দিয়ে মুরগীর ঝোল।
গতকাল বিকেলে বিন্তিকে আরেকবার ডাক্তারের কাছে নেয়া হয়েছে। রিপোর্টগুলো ঠিকঠাক ছিল। ডাক্তার বলেছেন পরেরবার ওর ওষুধের মাত্রাটা কমিয়ে দেবেন। একফাঁকে ওর পড়াশোনার কথাটা আলাপ করেছে ইলোরা। কেন কিছুই মনে থাকে না ওর! আর দশটা বাচ্চার মতো বিন্তিও যেন সব করতে পারে মা হিসেবে এটুকুই তো চায় সে।
ডাক্তার বললেন ওর খিঁচুনির সমস্যার জন্য যে ওষুধ দেয়া হয়েছে তার অনেক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে ৷ তাতে ব্রেনের উপর বেশ চাপ পড়ে। ওষুধের মাত্রা কমানো হলে ধীরে ধীরে সেসব কেটে যাবে, একটা সময় মনোযোগও ফিরে আসবে। আপাতত ওর সুস্থ থাকার দিকেই যেন জোর দেয়া হয়।
ডাক্তার যা বললেন চেম্বারের বাইরে বসে শাফিনও তাই বলছিল। কিন্তু ইলোরার মন মানে না। ওর দুশ্চিন্তা দেখে শাফিন বিরক্ত হয়। বলে- তুমি অযথা এত ভাবো!
ইলোরা মনে মনে বলে- মা হলে বুঝতে!
দুপুরে খেয়ে বিন্তি সেই যে ঘুমিয়েছে এখনো ওঠেনি। অফিস থেকে ফিরে শাফিন অন্যদিনের মতোই মেয়ের পাশে গিয়ে বসে। আজকে বিন্তি কী কী গল্প করেছে ইলোরা একটু আগে সব বলেছে ওকে।
শাফিন মেয়ের কপালে হাত রাখে ৷ জ্বর নেই। আর না আসুক অমন জ্বর। কী নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে বিন্তি! বড় বড় পাপড়ির চোখ দু’টোতে অনেক মায়া। থোকা থোকা কোঁকড়া চুল ফ্যানের হাওয়ায় কপালে এসে পড়েছে। ওর চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে ড্রইং খাতার পাতা উল্টায় শাফিন। ইলোরা মেয়ের প্রেসক্রিপশনগুলো গুছিয়ে একটা ফাইলে তুলে রাখছিল। শাফিনের ডাকে ফিরে আসতে হলো তাকে। খাতাটা এগিয়ে দিল শাফিন।
একটা হলুদ রঙের প্রজাপতি এঁকেছে বিন্তি। নিচে আঁকাবাঁকা অক্ষরে লিখেছে – আমি উড়বো।
ছবিটায় হাত বুলায় ইলোরা, ওড়নায় বারবার চোখ মোছে । তবু সব ঝাপসা দেখায়।
শাফিন বলে- প্রজাপতিটা উড়বেই, তুমি একদম ভেবো না।
মিষ্টি একটা গল্প। আমার সন্তানের গল্প।