৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয়ে গেল কালির তৃতীয় বৈঠক। আলোচনা করা হলো বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের উপন্যাস ‘বিষণ্ণ শহরের দহন’ নিয়ে। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কালির সদস্য কবি মালেকা ফেরদৌস, কথাসাহিত্যিক মনি হায়দার, কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমান। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সেলিনা হোসেন। ফুলের গুচ্ছ দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁদের বরণ করে নিল আফরোজা আকতার টিনা ও জাফরিন লিয়া। ঘণ্টা আর মিনিটের কাঁটা এক যোগে তখন ৫ টা ছুঁয়েছে। অনুষ্ঠানের শুরুতেই সদ্যপ্রয়াত কথা সাহিত্যিক রিজিয়া রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরিবতা পালন করা হলো।
কবি মালেকা ফেরদৌসের আলোচনার শুরুতে ঔপন্যাসিক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক সেলিনা হোসেনকে বাংলা সাহিত্যের মহীরুহ আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, ‘বিষণ্ণ শহরের দহন’ উপন্যাসটি সেলিনা হোসেনের ধ্রুপদীপ্রতীম সাহিত্যকর্ম। মানব চরিত্রের সাথে বিবেকের মত শহর ও হাওয়া দুটো প্রধান চরিত্র লেখক এই উপন্যাসে সন্নিবেশ করেছেন। উপন্যাসের কেন্দ্রে এক তরুণ খুনি সুজন। স্ত্রী মুনিরা তার পরকীয়ায় বাঁধা দিয়েছে বলে তাকে কুপিয়ে হত্যা করেছে সুজন। খুনের মূলে আসমা নামের এক বিবাহিতা রমনী। এই নারীকে নিয়েই মুনিরার প্রত্যাহিক দ্বন্দ্ব সংঘাত ব্যাপার হয়ে উঠেছিল সুজনের সাথে। বিচারে সুজনের ফাঁসি হয়। কনডেম সেলে শহর সুজনের সাথে কথা বলে। কিন্তু রাগ আর চিৎকার ছাড়া সুজনের আর কিছু নেই। রুদ্ধশ্বাস এ ফাঁসির কাহিনীর বর্ণনায় লেখক অত্যন্ত মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। সুজনের মৃত্যুর আগে ফ্লাড লাইটের আলোকে স্নিগ্ধ চাঁদের আলোর মত মনে হয়েছে। পৃথিবীর সুন্দরতাকে সুজন প্রথম দেখেছে। এখানে লেখক মানুষের বাঁচার আকুতিই ফুটিয়ে তুলেছেন।
শহর আর হাওয়ার মত আরও একটি চারণের মত চরিত্র সুফিয়া খাতুন। ভীষণ দুঃখী। হাওয়ার খেরো খাতায় যা লেখা হয় তা শহরকে পড়ে পড়ে শোনায়, সে খবরটিই আবার সুফিয়াকে শহর দেয়। এক প্রতিবাদী, মানবিক নারী সুফিয়া। ধর্ষণের মামলা করতে গেলে খুন হয়ে যায় নিধুরাম ধর্ষকদের হাতেই। সুফিয়ার কানে ঢোলের বাজনা আসে। উদগ্রীব সুফিয়াকে বাতাস জানায়- নিধুরামের কিশোর ছেলে বাবার লাশ দাহ করতে গেলে খুনিরা ছেলেটিকে মেরে অন্য গ্রামের শ্মশানে পাঠায় দাহ করতে আর খুনির ছেলে যায় বিয়ে করতে তাই এই ঢোলের বাজনা। বিচারহীনতা, ক্ষমতাবানদের আস্ফালন আর অত্যাচারে কিভাবে এ দেশের চিরাচরিত সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। তার ভয়াবহ ও সকরুণ বর্ণনা এই উপন্যাসটিতে আছে।
মালেকা ফেরদৌস আরও বলেন, বইটিতে লারার প্রসঙ্গ এসেছে। এসেছে তার নামে সমাজকল্যাণ মূলক ফাউন্ডেশনের কথা। লারা এক দুঃসাহসী কন্যার নাম। সেলিনা হোসেনের নিজের মেয়ে। এছাড়াও উপন্যাসটিতে ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১১ পিলখানার সেনা অফিসার হত্যাকাণ্ডে একটা পরিবারের করুণ কাহিনীর বর্ণনা করা হয়েছে। লেখক সেলিনা হোসেনের লেখার জগৎ বাংলাদেশের মানুষ, তার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। তার উপন্যাসে সাধারণত প্রতিফলিত হয় সমকালের সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সংকটের সামগ্রিকতা। এই উপন্যাসে তিনি অবক্ষয়িত সমাজের নানা দিক নিয়ে অত্যন্ত নির্ভীক কন্ঠে বলেছেন। দেশ, মাটি বিশেষ করে গণমানুষের সাথে একাত্মতা ছাড়া মহৎ ও কালজয়ী শিল্পী হওয়া যায় না।যদি না তাদের সাহিত্য ও শিল্প কর্মে মৃত্তিকা, মানুষের শ্রম, ঘামের উষ্ণ পরশ, জীবন সংগ্রাম, কষ্ট, যন্ত্রনার রূপ না থাকে।
কথাসাহিত্যিক মনি হায়দার বিষণ্ণ শহরের দহন নিয়ে বলেন- একজন লেখক কতভাবেই না নিজেকে চিত্রায়িত করতে পারেন, ভাঙতে পারেন, গড়তে পারেন। শহর ও বাতাসকে চরিত্রে পরিণত করে একটি বিপন্ন, বিষণ্ণ শহরের চালচিত্র তুলে ধরেছেন সেলিনা হোসেন। সাধারণত যে চরিত্রগুলো দিয়ে উপন্যাস শুরু হয়, সে চরিত্রগুলো দিয়েই শেষ হয়। কিন্তু এ উপন্যাসে তা হয়নি। কারণ মূল চরিত্র শহর ও বাতাস। শহর বলছে এই শহরে ঘটে যাওয়া অপঘাত, নির্মম অমানবিক মৃত্যুর কথা। বাতাস এই তথ্যগুলো পৌঁছে দিচ্ছে শহরের মানুষ অর্থাৎ অন্যান্য চরিত্রদের কাছে। তখন শহরের মানুষ বেদনার্ত হয়। সেই বেদনা পাঠক হিসেবে আমরাও ধারণ করি। উপন্যাসের এক তরুণ চরিত্র সুজন। স্ত্রী মুনিরা পরকীয়ায় বাধা দিলে সে মুনিরাকে হত্যা করে। কনডেম সেলে তাঁর মধ্যে কোনো বিকার কাজ করে না। অপরাধবোধ কাজ করে না। আমরা সবাই যেন মানবিকতার মুখোশ পরে সুজনের মতোই জান্তব পশু হয়ে উঠছি।
মনি হায়দার আলোচনায় উল্লেখ করেন- সেলিনা হোসেন চারপাশে বাস্তবচিত্রই উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন মাদকসেবী দাউদের স্ত্রী সুফিয়ার কথা। মায়ের কোল থেকে ছেলেকে কেড়ে নিয়ে যে বিক্রি করে দিয়েছে। উপন্যাসের ছয় পর্ব থেকে সুফিয়া খাতুনের আখ্যান শুরু হয়েছে। সুফিয়া শুনছে, শহর বলছে, তোমরা কাশ্মীরকন্যা ধর্ষিতা আসিফার কথা শোনো। সুফিয়া শোনে ছোট ছোট শিশুদের ধর্ষণের কথা। এই সুফিয়াই পরে একটি বলিষ্ট কণ্ঠ হয়ে উপন্যাসে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। সৌদি আরবে গৃহকর্মীদের ওপর যে পাশবিক আচরণ করা হয় সেটি সেলিনা হোসেন উল্লেখ করেছেন। নিপীড়নের সে বর্ণনা শিউরে ওঠার মতো। এসেছে পিলখানার নির্মম হত্যাযজ্ঞের কথা। কেন সে হত্যাকাণ্ড হয়েছিল সেটা কেউ জানে না। সে বিষয়ে লেখার সুযোগ আছে। বক্তব্যের শেষে কালি সংগঠন ও কালির সাথে যারা আছেন সকলকে ধন্যবাদ জানান মনি হায়দার।
কথাশিল্পী স্বকৃত নোমান আলোচনার শুরুতেই বলেন, তিনি মূলত তার পাঠ একাত্মতা বা প্রতিক্রিয়া উল্লেখ করবেন। উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে সুজনের আখ্যানে স্বকৃত নোমানের বিশ বছর আগে চাঞ্চল্যকর শারমিন রীমা হত্যা কথা মনে পড়ে যায়। তিনটি আলাদা আখ্যানের উল্লেখ করে বলেন- এ আঙ্গিকের উপন্যাস তিনি আগে পড়েননি। সুজনের ফাঁসির পর কী হতে পারে, সেতা নিয়ে ভাবছিলেন। পরে দেখলেন গল্পটি বিভিন্ন মানুষের কাহিনী। সুজনের ফাঁসির পর সফলতার সাথে তিনি শহরের অন্যান্য চরিত্র দিয়ে ধর্ষণ, বিডিআর বিদ্রোহের কথা তুলে ধরেছেন।
স্বকৃত নোমান বলেন- একটি বিষয়কেও সেলিনা হোসেন অসাধারণ নির্মাণে গল্পে ও উপন্যাসে রূপ দিতে পারেন। তাঁর প্রাণ থেকে নির্গত কথা অন্যকে আছর করে। সে কথা লেখকের ভিতর থেকে উদ্গারিত উৎসারিত হয়ে পাঠকের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। সেলিনা হোসেন সেই শক্তিমান কথাসাহিত্যিক যিনি প্রাণ থেকে লেখেন। খুব সামান্য তুচ্ছ ঘটনাও এমনভাবে লেখেন যেন তিনি এ ব্যাপারে সবই জানতেন। পুরো ব্যাপারটি তাঁর আয়ত্তে। সেলিনা হোসেনের লেখা পড়লে বানানো মনে হয় না। আসলে প্রতিটা শিল্প তো বানানোই। রামায়ন, মহাভারত, ইলিয়াড ও ওডিসি বানানো। লেখকের সার্কতা সেখানেই যেখানে পাঠকের কাছে লেখাটা বানানো মনে হয় না। স্বতস্ফূর্ত সে আখ্যান।
স্বকৃত নোমান আলোচনায় বলেন, এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র শহর। বিভিন্ন ঘটনায় আখ্যানে এটা বিচ্ছিন্ন উপন্যাস নয়। একক উপন্যাস। বাতাস ও শহরকে চরিত্র নির্মান করে লেখা এই উপন্যাসকে তিনি অভাবিত এক পাঠ অভিজ্ঞতা হিসেবে উল্লেখ করেন।
কালির বৈঠক ৩ এ যার উপস্থিতি প্রদীপের শিখা হয়ে আলো ছড়িয়েছে তিনি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। কালি এত মানুষ একত্রিত করে এই উপন্যাসটি আলোচনা করেছে, সেজন্য অনুষ্ঠানটিকে নিজের জন্য গৌরবময় বলে মনে করেন তিনি। আলোচকদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রশংসা করে বলেন- এ উপন্যাসের প্রতিটি গল্প বাস্তব থেকে নেয়া সত্যিকারের ঘটনা। গল্পের যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু রেখে বাকি সব বদলে দিয়েছেন। সুজনের গল্পে ধারাবাহিকতা রাখার জন্য জেলখানায় জল্লাদের জীবন তিনি পাঠকের সাথে ভাগ করে নিয়েছেন।
পিলখানার ঘটনাটিও তাঁর নিজের জীবন থেকে নেয়া। সৌদি আরব প্রসঙ্গে যে নারীর কথা উঠে এসেছে, সে নারী ফাউন্ডেশানের পিয়ন ছিল। সৌদি আরব যেতে ইচ্ছুক নারীকে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, তুই কি জানিস ওরা শারিরীক নির্যাতন করে? বাম হাতের কাপড় সরিয়ে ওই নারী দেখিয়েছিল, এখানে দালালরা ইঞ্জেকশান দিয়ে দিয়েছে। যা কিছুই ঘটুক তিন বছরে গর্ভ হবে না। উপন্যাসের মাদকাসক্ত লোকটিও বাস্তব থেকে পাওয়া। বরগুনায় তিনি দেখেছেন, টাকার জন্য সেই ব্যক্তি দু বছরের ছেলেকে বিক্রি করে দিয়েছে। সেলিনা হোসেন বলেন- উপন্যাসের সবকিছুই বাস্তব অভিজ্ঞতার জায়গা থেকে নেয়া। তারপর কল্পনা দিয়ে গল্প তৈরি করা, সংলাপ দেয়া, কাহিনী গড়া। সমাজের অবক্ষয়কে নিয়েই শহরের এই উপন্যাস রচিত। একটি শহরের বিভিন্ন জায়গায় এসব ঘটনা ঘটে। শহর বিষণ্ণ হয়। শহর ও বাতাস দুজন বন্ধুর মতো মানুষের বিষগুলো দেখছে এবং অপকর্মের সমালোচনা করছে। কাশ্মীরের ঘটনাটি বেশ কটি পত্রিকা ঘেঁটে সেখানকার তথ্য নিয়ে লিখেছেন।
সেলিনা হোসেন পাপড়ি রহমানকে সময়ের অন্যতম লেখক বলে্ন এবং ধন্যবাদ জানান। কালির সাথে যুক্ত সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন- শিল্পসাহিত্যে ভালোমন্দ আলোচনা থাকবে। আজকের আয়োজনটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ আয়োজনের মধ্য দিয়ে পাঠকের কাছে একটি সাহিত্যকর্ম পৌঁছে যাবার সুযোগ পেল। একজন পাঠক নিজেই পড়ে জানবে উপন্যাসটি তার কাছে কেমন লাগল।
কবি খাতুনে জান্নাত এবং কথাশিল্পী শারমিন জাহান শাম্মী। ‘বিষণ্ণ শহরের দহন’ উপন্যাস থেকে অংশ বিশেষ পাঠ করেন। উন্মুক্ত আলোচনা পর্বে বক্তব্য রাখেন কথাসাহিত্যিক মোজাফফর হোসেন। সেলিনা হোসেনের সাহিত্য নিয়ে এ পর্বে আলোচনা করেন কথাশিল্পী মিঠুন রাকসাম এবং সংগঠক ও সম্পাদক সুজন হাজং। অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে কথাসাহিত্যিক পাপড়ি রহমান সমবেত অতিথিদের সাথে মাহমুদুল ইসলামের পরিচয় করিয়ে দেন। মাহমুদুল ইসলাম গ্রামে গ্রামে নিজ উদ্যোগে বই পড়ান আর গাছের চারা বিতরণ করেন। হাঁস-মুরগির খামার করেন। ডিম বিক্রি করে সেই টাকায় মানুষের জন্য বই কেনেন। মাহদুল ইসলাম সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন সেলিনা হোসেনের লেখা নিয়ে।
আলোচনার পর যথারীতি ফটোসেশান ও চা পর্ব মুখর হয়ে ওঠে পারস্পরিক আলাপচারিতায়। সবার আন্তরিক উপস্থিতি আর প্রচেষ্টায় কালির বৈঠক ৩ অনুষ্ঠিত হলো। ‘বিষণ্ণ শহরের দহন’ নিয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকটি সঞ্চালনা করেছেন ইশরাত তানিয়া।