বৈঠক ২: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারাগারের রোজনামচা :: ইশরাত তানিয়া

বৈঠক ২: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারাগারের রোজনামচা :: ইশরাত তানিয়া

অগাস্ট বাঙালি জাতির এক শোকাবহ মাস। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ এর ১৫ অগাস্ট কাল রাতে কতিপয়  ঘাতক সেনাসদস্য কর্তৃক মর্মান্তিকভাবে নিহত হন। এই শোকের মাসে কালির দ্বিতীয় বৈঠকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানানো হলো জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। কারাবাসের সময় তাঁর লিখিত দিন যাপনের কথামালা ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থটি নিয়ে আলোচনা করা হলো ৩ অগাস্ট, ২০১৯, ধানমন্ডির ইএমকে সেন্টারে।

এই অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক, কবি ও অনুবাদক হাবীবুল্লাহ সিরাজী এবং সহযোগী অধ্যাপক ও গল্পকার ড. ইশরাত তানিয়া। কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী ও ড. ইশরাত তানিয়াকে ফুলের তোড়া দিয়ে ‘কালি’র পক্ষ থেকে সম্বর্ধনা জানালেন শারমীন জাহান শাম্মী। অনিবার্য কারণে কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন আলোচনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননি।

কবি ও প্রভাষক আফরোজা আকতার টিনা অনুষ্ঠান সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন। নির্ধারিত সময়ে তিনি  অনুষ্ঠান শুরু করেন ‘কারাগারের রোজনামচা’ থেকে অংশবিশেষ পাঠের জন্য লায়লা মুন্নীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে। বাচিক শিল্পী ও কবি লায়লা মুন্নী কারাগারে অন্তরীণ বঙ্গবন্ধুর ১৯৬৭ সালে লেখা কিছু অংশ পাঠ করেন। তিনি যে অংশটুকু পাঠ করলেন সেখানে মূলত ছিল ঢাকা জেলের ভেতর স্ত্রী ও সন্তানদের সাথে দেখা করার জন্য বঙ্গবন্ধুর গভীর আগ্রহের কথা। একই সাথে তাঁর ভাবনা জুড়ে ছিল  ৬ দফার আন্দোলন। তিনি ভাবছেন বিরোধীদলগুলোকে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট করা যায় কিনা।

তারপর ‘কারাগারের রোজনামচা’ নিয়ে আলোচনা করেন বৈঠকের নির্ধারিত আলোচক ড. ইশরাত তানিয়া। তিনি আলোচনার শুরুতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারাবাসের দুইটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন এবং বর্তমান সময়ে বঙ্গবন্ধুর প্রাসঙ্গিকতা উল্লেখ করে আলোচনা শেষ করেন। দুটি প্রেক্ষাপটের একটি ৬ দফা দাবীর আন্দোলন আরেক্টি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা।

১৯৬৬ সালে ৬ দফা দাবী পেশ করার পর বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন। ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত কারাগারে বন্দী থাকেন। সে সময় কারাগারে ডায়েরি লেখা শুরু করেন। কারাগারে অন্তরীণ থাকাকালীন ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত তাঁর লেখাগুলো এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত। ১৯৫২র ভাষা আন্দোলনের সময় থেকে ৭১ এ স্বাধীনতা অর্জন কতটা সংগ্রামের, লড়াইয়ের আর আত্মত্যাগের সেই চিহ্ন বহন করছে ‘কারাগারের রোজনামচা’। একটি মহৎ অর্জন সম্ভব হয়েছে জাতির পিতার মহান ত্যাগের বিনিময়ে। এত কষ্ট আর ত্যাগের ফলে পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ।

ড. ইশরাত তানিয়া বলেন, ডায়রিতে তাঁর লেখাগুলো বিশ্লেষণ করলে তিনটি বিষয় উল্লেখ করা যায়। তা হলো কারাগারের জীবন যাপন, ব্যক্তিগত ভাবনা এবং পারিবারিক কথা। এর পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু প্রাসঙ্গিকভাবে বিশ্ব রাজনীতি ও দেশীয় সমাজ ব্যবস্থার চিত্র তুলে ধরেছেন। এই বইটি পাঠ করলে বোঝা যায় কিভাবে তিনি একজন অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠছেন। কেন তাকে মহাত্মা গান্ধী, নেলসন ম্যান্ডেলার মতো বিশ্ব নেতার সাথে তুলনা করা হয়। সে উত্তরের কিছু সত্যতা এই বইতে পাওয়া যাবে। গান্ধী এবং ম্যান্ডেলার মতো বঙ্গবন্ধুও ছিলেন আপোষহীন, নিপীড়িত মানুষের আশার প্রতীক, পরাধীন জাতির মুক্তির স্বপ্নদ্রষ্টা।

রোজনামচায় বঙ্গবন্ধু কারাগারের পরিবেশ, নিয়মকানুন, কাজকর্মের সাথে বর্ণনা দিয়েছেন। পাকিস্তান আমলের কারাগারের যে অনুপুঙ্খ বিবরণ তিনি দিয়েছেন সেটি ইতিহাসে বিরল। ফলে কারাগার নিয়ে গবেষকদের জন্য একটি নতুন তথ্যকোষ উন্মোচিত হলো। আর পাঠকের সুবিধা হলো এই, কারাগারের ভেতরটা জেনে বুঝে নিয়েই পাঠে এগিয়ে যেতে পারে স্বাচ্ছন্দ্যে, সহজভাবে। জানতে পারে জেলের জীবন, কয়েদিদের সম্পর্কে অজানা অনেক কথা, অপরাধীদের ব্যক্তিগত জীবন এবং অপরাধ জগতে প্রবেশের কাহিনী।

কারাগারে তিনি বই পড়েছেন। এমিল জোলার লেখা- তেরেসা রেকুইন।  দিনলিপিতে বিশ্ব রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনায় তিনি প্রাসঙ্গিকভাবে বিশ্ব নেতাদের নাম উল্লেখ করেছেন, যেমন- সোভিয়েত ইউনিয়নের অ্যালেক্সি কোসিগিন, ভারতের কৃষ্ণ মেনন, জওহরলাল নেহেরু, আফ্রিকার প্যাট্রিস লুলুম্বা, কিংবা আমেরিকার দার্শনিক, কবি ও রাষ্ট্রতত্ত্ববীদ হেনরি ডেভিড থরো’র কথা।

তাঁকে গ্রেফতারের পর তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি, পত্রপত্রিকার অবস্থা, শাসকদের নির্যাতন, ৬ দফা  বাদ দিয়ে ৮ দফা করে আন্দোলন ভিন্নখাতে নিয়ে যাবার চেষ্টার কথা এখানে স্পষ্ট করে লেখা আছে। তার মুক্তির দাবীতে ৭ জুন দেশব্যাপী স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট পালিত হয়। জেলখানার ভেতর উদ্বিগ্ন বঙ্গবন্ধু। তিনি লিখেছেন, “কারাগারের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেদ করে খবর আসল দোকানপাট, গাড়ি, বাস, রিকশা সব বন্ধ। শ্নাতিপূর্ণভাবে হরতাল চলছে।” খবর আসে পুলিশ আর আনসারবাহিনীতে ঢাকা শহর ভরে গেছে। আবার খবর এলো টিয়ার গ্যাস ছেড়েছে। লাঠি চার্জ হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু সব বুঝতে পারেন না। কয়েদিরে কয়েদিদের বলছে। সিপাইরা সিপাইদের বলছে। এসব বলাবলির ভেতর অনেক খবর বেরিয়ে আসে।  রাতে তাঁর ঘুম হয় না। মানুষ যখন অমানুষ হয় তখন হিংস্র জন্তুত চেয়েও হিংস্র হয়ে ওঠে। পশ্চিমা উপনিবেশবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল্পশ্চিম পাকিস্তানের শোষক শ্রেণী যে আর পূর্ব বাংলার নির্যাতিত গরীব জনসাধারণকে শোষণ বেশি দিন করতে পারবে না, সেকথা তিনি এবার জেলে এসেই বুঝেছেন। তিনি লিখেছেন, “পাকিস্তানের মঙ্গলের জন্য শাসক শ্রেণীর ছয়দফা মেনে নিয়ে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করা উচিত।” কারাগারে আওয়ামীলীগ নেতা কর্মীদের দুর্দশা তার উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা এটাই প্রকাশ করে দলের সদস্যদের তিনি কতটা ভালোবাসতেন। তাঁদের কল্যাণ নিয়ে চিন্তিত থাকতেন।

৬৮ সালে জানুয়ারী মাসের ১৮ তারিখ কারাগারের গেট দিয়ে বাইরে এলে সেনাবাহিনীর লোকজন আবার তাকে গ্রেপ্তার করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে বন্দি করে রাখে। সেখানে একটা ঘরে  গাঢ় লাল রঙের মোটা পর্দা, কাচে লাল রঙ করা, চব্বিশ ঘন্টা উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্নলাইট ২৪ ঘন্টা জ্বলছে। এমন একটা অ বথায় তাঁকে দীর্ঘদিন একাকী থাকতে হয়েছে। এমন ভয়ানক অত্যাচার তাঁকে দিনের পর দিন করা হয়েছে। পত্রিকা নেই, বই নেই। ৫ মাস পর খাতা পেয়ে উল্লেখ করলেন যে, এমন ঘরে তিনি বন্দী যে দিন কি রাত বোঝা যেত না। তাই দিন তারিখ ঠিক করতে পারতেন না।

ড. ইশরাত তানিয়া মনে করেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব কিংবা অন্যান্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য তো বটেই এছাড়াও তিনি দেশ ও জাতির জন্য আত্মত্যাগ করেছেন বলেই পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। কিন্তু তিনি যে রাষ্ট্র নির্মান করে গেছেন সে রাষ্ট্রযন্ত্রে জনগণের পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়নি, সমাজ ব্যবস্থায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তিনি বাংলার জনগণের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক মুক্তির স্বপ্ন দেখেছেন। যতদিন না পর্যন্ত তাঁর এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন হচ্ছে, রাষ্ট্রযন্ত্রে জনগণের পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্টিত হচ্ছে, সমাজ ব্যবস্থায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু প্রাসঙ্গিক এবং তাঁর রাজনীতির চর্চা এবং প্রতিষ্ঠা জরুরি।

অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে কারাগারের রোজনামচা থেকে পাঠ করেন কবি সুলতানা ফিরদৌসী। তিনি বঙ্গবন্ধুর লেখা ১৯৬৬ সালের কয়েকদিনের কথা পাঠ করেন। সেলের বাইরে দুটি ছোট্ট হলুদ পাখির কথা, পরিবারকে ঘিরে বঙ্গবন্ধুর মায়া মমতা ও উদ্বিগ্নতার কথা পড়ে শোনান তিনি। কথাসাহিত্যিক পাপড়ি রহমানের গল্প ‘দুর্বাঘাসের অশ্রুশিশির’ পাঠ করেন প্রভাষক ও কবি আফরোজা আকতার টিনা। বঙ্গবন্ধু কারাবাসের দিনগুলো ছিল এই গল্পের মূল উপজীব্য। অবরুদ্ধ বঙ্গবন্ধুর মানসিক অবস্থার কথা গল্পটিতে ফুটে উঠেছে। অন্ধকার  নির্জন সেল আর একটুকরো বাগানে দুর্বা আর বাদলাঘাসের  কথা লেখক রূপকাশ্রয়ী বর্ণনা গল্পটিকে অনবদ্য করে তুলেছে ।

গল্প পাঠের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে এবং বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গ করা কবিতা পাঠের মাধ্যমে আলোচনা শুরু করেন বাংলা একাডেমির মহা পরিচালক, কবি ও অনুবাদক হাবীবুল্লাহ সিরাজী। তিনি পাঠ করেন এক অপূর্ব কবিতা। সে এক নামের খেলা। নক্ষত্রের নাম থাকে, বস্তুর নাম থাকে। একদিন একটি দেশও ‘নাম’ পেয়ে যায়, দেশের মানুষরাও একটি নামে চিহ্নিত হয়-

 সবকিছুরই একটা-না-একটা নাম থাকে।

নক্ষত্রের নাম থাকে জ্যোতির্মণ্ডলে

মেঘের সঙ্গে মিলিয়ে বৃষ্টির নাম

জোছনায় শিশির পতনের নাম;

হাওয়ার দাপটে থাকে পল্লব ও পুষ্পের নাম;

দূরে যাবার নাম, বিষয়- বিজ্ঞানের নাম

পরিস্থিতি ও পরাজয়ের নাম

নাম, ধাতু ও ধৈর্যের।

কার নাম নেই?

সুন্দর বনের বাঘ? পদ্মার ইলিশ?

রবিন্দ্রনাথের গল্প? ছাতকের পাথর?

না, নামহীন কিছু নেই।

নাম এক প্রকার ভালোবাসাবাসি

কার সঙ্গে কার ভাব বোঝা দায়!

নাম দীর্ঘ হয়, নাম বাড়ে, নাম ভাঙে

নতুন পুরনো নিয়ে নামে নামে কাড়াকাড়ি হয়:

এভাবেই একদিন দেশের নাম বাংলাদেশ হ’য়ে গেলে

মানুষের নাম হয়

শেখ মুজিবুর রহমান।

কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন, ১৯০৫ সালে বাঙ্গালী মুসলমান একটি সঙ্কটে পড়ে বঙ্গভঙ্গ নিয়ে। বঙ্গভঙ্গ রদের মাধ্যমে এই সংকোটের সাময়িক সুরাহা হয়। এর পর থেকে নব্য সঙ্কট তৈরি করার জন্য দায়ী উপনিবেশবাদ, আমাদের অন্তর্কলহ, পারস্পরিক স্বার্থ। তিনি বলেন, পুর্ববঙ্গে কিক্ষার হার ছিল কম। বাংলার বিবেচনায় আমরা ছিলাম অনুন্নত। এখানে সংখ্যাধিক্যে যারা ছিলেন, ধর্মীয় পরিচয়ে তারা মুসলমান। তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য ১৯২০ সালে একজন জন্ম গ্রহণ করেছিলেন পূর্ব বাংলায়। বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায়। এ যেন তাঁর আবির্ভাব। আমাদের জন্য তিনি ছিলেন ত্রাতার মতো। জাতি হিসেবে  পরিচয় পাবার জন্য আমরা একটা আশ্রয় খুঁজছিলাম। আমাদের এ কে ফজলুল হক ছিলেন, মোলানা ভাসানী ছিলেন কিন্তু এই ভূমি থেকে পায়ে কাদা মেখে মধুমতীর পানিতে অবগাহন শেষে যিনি তাঁর প্রতিজ্ঞার অংশটুকু রেখেছিলেন বাঙালির কাছে সেটা আর কারো ভেতরে ছিল না। ছিল না বলেই তিনি বঙ্গবন্ধু হতে  পেরেছেন। আজ তাঁর রচনার মধ্য দিয়ে আমরা পরবর্তী প্রজন্মকে অন্তত এটুকু বলতে পারি, বন্ধুরা, সন্তানেরা দেখো, যে মানুষটি কর্মগুণের মধ্য দিয়ে একটি দেশ সারা বিশ্বের কাছে আমাকে দিয়ে গেছে তাঁর এই গ্রন্থটি দেখো। পড়ো এই কারাগারের রোজনামচা।

১৯৪৮ এর ১১ মার্চ বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা হবে এ নিয়ে প্রতিবাদের স্বর উঠল। সেই স্বরটি ছিল বঙ্গবন্ধুর।   ১৯৪৮ থেকে ১৯৫১ সময়টুকু দাপ্তরিকভাবে অর্থাৎ সরকারি ভাবে সিক্রেট ডকুউমেন্টস অফ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভলিয়্যুম ১ এ পাওয়া যাবে। তৎকালে পাকিস্তানী শাসকদের গোয়েন্দা, পুলিশ, প্রতিরক্ষা বাহিনী যে রিপোর্টটি লিখেছে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে, সেটি অবিকল অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছে। ভলিয়্যু ২ তে  আছে ১৯৫১-১৯৫২ সাল পর্যন্ত ঘটনা প্রবাহ। দালিলিক রিপোর্ট হিসেবে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বের হবার  আগ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল বদরুদ্দীন ওমরের লেখা ‘ ভাষা আন্দোলন ও পূর্ব বাংলার তৎকালীন রাজনীতি’ একমাত্র গ্রাহী বই। কিন্তু অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও সিক্রেট ডকুমেন্টস অফ বঙ্গবন্ধু পড়লে এক  তরফা লেখার বাইরেও গ্রহনযোগ্য তথ্য পাওয়া যাবে। তিনি আরও উল্লেখ করেন, এর আগে আমরা বঙ্গবন্ধুর  আত্মজীবনীমূলক বই  পেয়েছি। আগামী বছর আরেকটি গ্রন্থ পাওয়া যাবে তাঁর চীন ভ্রমণ নিয়ে।

‘কারাগারের রোজনামচা’ আড়াই বছরের ব্যাপ্ত হলেও ১৯৪৭ এর দেশভাগ থেকে থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত ৬  দফা পরবর্তীকালের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়েই তিনি লিখেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভূমিকায় লিখেছেন খাতাগুলো কিভাবে উদ্ধার করা হয়েছিলো এবং কিভাবে জনসম্মুখে বই আকারে প্রকাশ করা হলো।

বঙ্গবন্ধু খাতার শুরুতেই লিখেছেন- থালা বাটি কম্বল/জেলখানার সম্বল। লিখেছেন জেলখানার বিভিন্ন  দফা/ডিপার্টমেন্টের কথা। জেলখানায় না গেলে এই দফাগুলোর কর্মকাণ্ড বোঝা যায় না। একজন মানবিক কয়েদী যদি তাঁর ভেতরটাকে তুলে এনে জেলের বিষয়গুলো দেখেন সেই দৃষ্টিভঙ্গীতেই বঙ্গবন্ধু তাঁর এই কথাগুলো লিখেছেন। সেলের ভেতর সেল। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীতে তিনি বলেছেন, দুয়ের অধিক কয়েদী এক সেলে থাকতে পারে কিন্তু এক সেলে দুজনকে রাখা  হয় না ব্যভিচারের ভয়ে। তিনি রান্না করে খেতেন। আড়াই টাকা তাঁর বরাদ্দ থেকে দিন দিন কিছু বাঁচিয়ে তাঁর সহযগী কর্মী, সহবন্দীদের আবদার মিটিয়েছেন। খিচুড়ি, ডিম আর মুরগীর মাংস রান্না করে খাইয়েছেন। তিনি এতটাই  বন্ধুবৎসল ছিলেন। স্বাধীনতার আগে তাঁর ৩২ নাম্বারের বাড়িতে গিয়ে কেউ ভাত না খেয়ে ফিরে আসে নাই।

হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন, এই বই আমাদের আত্মপরিচয়। পূর্ব বাংলা শোষিত কেন? এই প্রশ্নটি যে ব্যক্তি আপোষহীনভাবে করেছেন তিনি বঙ্গবন্ধু। আজ এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে কথা বলছি, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করছি। বন্ধবন্ধু না থাকলে এসব কখনোই হতো না। জাগ্রত বিবেকের তরফ  থেকে, মানবিক পৃথিবীর তরফ থেকে তাঁর প্রয়ান মাসে তাঁকে সালাম জানাই। সন্তানদের বলে যাই, আমরা যা করছি তা মানুষের জন্য যেন করি। সাংবিধানিকভাবে আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। প্রতিজ্ঞা হোক, আজ বাড়ি গিয়ে যেন সন্তানকে বলি, এই মানুষটি এই দেশ দিয়ে গিয়েছিল, তুমি তোমার সাধ্য মতো তোমার পতাকা, তোমার স্বাধীনতা, মাটি, সম্মান রাখার জন্য এই মানুষটিকে স্মরণ করো। আমরা যেন সংবেদনশীল হই। সৎ নিষ্ঠাবান হই। আমাদের অস্তিত্বের সাথে আমাদের দেশ, আমাদের সন্তান, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম জড়িত। আমরা মানুষের পাশে থাকব। শিল্পে, সাহিত্যে, সঙ্গীতে থাকব। একসঙ্গে কাজ করে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ  গড়ে তুলব। আমরা ভালোবাসাকে বিস্তারিত করব বাংলাদেশ আর বাংলা ভাষার জন্য। জয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জয় বাংলা।

তাঁর বক্তব্যের পর আলোচনায় অংশ গ্রহণ করেন অধ্যাপক নুরুল করিম নাসিম, অধ্যাপক ও কবি কামরুল হাসান এবং কবি ও গল্পকার দিলারা মেসবাহ। তাঁদের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা আর শোক পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।

চা-পর্ব ও ছবি তোলা শেষে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষনা করেন পাপড়ি রহমান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা আর সম্মান জানিয়ে শেষ হলো কালির দ্বিতীয় বৈঠক।

Leave a Reply