বই : ২২ আঙ্গুলের জীবন। লেখক: শাহ্নাজ মুন্নী
প্রকাশক : শব্দশিল্প। প্রকাশকাল : ডিসেম্বর, ২০০৮। প্রচ্ছদ : রাজিব রায়
অবচেতনে কোটি বছর আগের স্মৃতিও যাপন করে মানুষ, বিশ^াস অথবা সংশয়ের সাথে বহন করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। সেসব অনুভব থেকে উৎসারিত রহস্যের জট তাই ব্যাখ্যাতীতও বটে। সময় ও সভ্যতার যাত্রাপথে দৃশ্যমান সবকিছুর বদল ঘটলেও মানুষের চেতনা বিস্মৃত হওয়ার বা বহনের থাকে না কোন নির্দিষ্ট গতিপথ। উপন্যাসের পটভূমি সে গল্প নিয়েই। সময়ের সাথে এক প্রজন্মের মধ্যেই বদলে যাচ্ছে যাপনের ধরণ, সাথে বিশ্বাস ও অবিশ্বাসকে গ্রহণের ক্ষমতা। অথচ একইরকম প্রবাহিত হয়ে চলেছে অতি প্রাকৃত এক স্মৃতি। আর তা জীবনের গল্পে এমনভাবে স্থান করে নিচ্ছে যে, সত্যি না মিথ্যে সে ব্যবধানের সুযোগ থাকছে না পাঠকের। ২২ আঙ্গুলের জীবন উপন্যাসে প্রধান দুই চরিত্র মা ও আত্মজা, দুইজন দুই সময়ের প্রতিনিধি। আনারকলি বেড়ে উঠেছে ষাটের দশকের এক শান্ত মফস্বল শহরে আর তার কন্যার জন্ম এই শহরেই, বেড়ে ওঠা সত্তর ও আশির দশক ঘিরে। উপন্যাসের একটি অন্যতম চরিত্র অতি প্রাকৃত মিকাঈল। আমার বিবেচনায়, চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রটি ডুুমুরিয়া গ্রামের সোহাগী। খুব সাধারণ এই নারী উপন্যাসে সামান্যই স্থান পেয়েছে তবে একটি ঘটনা দিয়েই শাহ্নাজ মুন্নী মনোজগতের এক ব্যাখ্যাতীত অনুভব উপস্থিত করেছেন পাঠকের জন্য। অল্প বয়সের এই তরুণী বউ সোহাগী ভাবি আমুদে মানুষ। আদি রস করে আমোদ পান আর কথায় কথায় হেসে গড়িয়ে পড়েন তবে সে মানুষেরও মনে অন্য পালের হাওয়া। কিন্তু সে হাওয়া কোন মানুষের জন্য নাকি অদেখা কোন জায়গা বা অন্যরকম জীবন সে বিষয়ে সোহাগী নিজেই অনিশ্চিত। স্বামীর সাথে সামান্য বিবাদের সূত্র ধরে সোহাগী একদিন হাসতে হাসতে নিজের গলায় দা চালিয়ে দিলো। দৃশ্যমান কারণটা বিবাদ হলেও এর অন্য তলেরও আভাস দিয়েছেন লেখক। অপরিচিত কোন অনুভবের সাথে পরিচয় ও অপরিচয়ের ভেতর দিয়ে স্পর্শ করতে না পারার অক্ষমতা মানুষকে ঠেলে দিতে পারে আত্মহননের দিকে।
প্রধান দুই নারীর গল্পে আসার আগে অতিপ্রাকৃত মিকাঈলের সাথে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। উত্তম পুরুষে উপন্যাসের শুরু হয়েছে নগর জীবনের নারী সিলভিকে দিয়ে। সিলভির মা আনারকলি। আনারকলির দাদাজানের মক্তবে এক ছাত্র পড়তে আসত। ক্রমেই আবিস্কার হলো সে ছাত্রের অলৌকিক কিছু ক্ষমতা রয়েছে। এরপর বোঝা গেলো মিকাঈল নামের ওই ছাত্র আসলে মানুষ নয়। এই মিকাঈলের গল্প আনারকলি ছোটবেলা থেকে গল্পে গল্পে শুনেছেন। আর তখন থেকে মাঝে মাঝে তাঁর স্বপ্নে উপস্থিত হতে শুরু করে মিকাঈল। মিকাঈল এসে অদৃশ্য কালিতে আনারকলির হাতে নিজের নাম লিখে যায়। এই উপস্থিতি অতিপ্রাকৃত তো বটেই পাঠকের জন্য কিছুটা অস্বস্তিরও। আনারকলি দ্যাখেন, একটি বড় গাছ থেকে কুয়াশার মতো নেমে আসছে সে। আঙ্গুলগুলো ধীরে ধীরে হয়ে যাচ্ছে কলমের নিবের মতো। সে আঙ্গুল দিয়েই হাতে নাম লিখে মিকাঈল বলে, এই নামের দিকে তাকিয়ে আমাকে মনে করলে তোমার কাছে আসব আমি। মিকাঈলই আনারকলিকে স্বপ্ন দেখায় ২২ আঙ্গুলের এক শিশুর জন্ম হবে তার গর্ভে, যার থাকবে বাইশ রকম গুণ। একই স্বপ্ন সিলভিও দেখে। উপন্যাসের শুরুতেই সেই শিশুর প্রসঙ্গ—- ‘ আমি সবসময় ভাবতাম আমরা একটা বাইশ আঙ্গুলে বাচ্চা হবে। বাইশ আঙ্গুল লম্বা না, লম্বায় স্বাভাবিকই থাকবে হয়তো, শুধু তার হাতে বা পায়ে অন্যসব মানুষের চেয়ে অন্তত দুইটা আঙ্গুল বেশি থাকবে। সেব হবে মানবক’লে এক বিরল প্রতিভা- যুক্তি, বুদ্ধি ও বিবেকে, শক্তি স্বপ্ন ও সাহসে।’
ফারুক নামে চাচাতো ভাইকে ভালোবাসত আনারকলি। কিন্তু সে বোধ নিজের কাছে স্পষ্ট হওয়ার আগেই অমতে বিয়ে হয় সিলভির বাবার সাথে। অত:পর একটা ঘর, একটা চুলা, একটা বিছানা ও দুজন মানুষের কথাবার্তা, আবেগ রাগ-অভিমান আর ভেতরে ভেতরে বাস্প হয়ে যাওয়া আবেগ নিয়ে সংসার শুরু। ডুমুরিয়া গ্রামের আনারকলির সব মানসিক সঙ্কটকালে মিকাঈল স্বপ্নে এসেছে।
আনারকলির তিন মেয়ের বড় মেয়ে সিলভি।সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ভালোবাসার সম্পর্কে আনারকলি ও তাঁর শিক্ষিত শহুরে মেয়ের অভিজ্ঞতা প্রায় এক। সিলভিও প্রথম প্রেমে পড়লো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সিনিয়র ভাইয়ের। মনের কথা প্রকাশের আগেই জানতে পারল, সে বিবাহিত। এই মানসিক সঙ্কটকালে কু-সংস্কারে অবিশ^াসী সিলভির স্বপ্নেও উপস্থিত হলো সেই মিকাঈল। আনারকলির দাদাজানের সময়কালের মিকাঈলের বয়স মানুষের মতো নয়। সিলভির জীবনের বর্ণনা দিতে দিতে লেখক তুলে এনেছেন দুই সময়কালের জীবন-যাপনের ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতি। গ্রামের সংস্কারের সাথে নগর জীবনের বিশ^াসের প্রভেদ, কয়েক দশক আগের নারীদের সহনশীলতার বিপরীতে বর্তমান নারীদের স্বনির্ভরতার চেষ্টা। শিক্ষার সাথে সাথে অতিপ্রাকৃততে মানুষের বিশ^াস- অবিশ^াসের কথা। বিশ্বাস অবিশ্বাসের ফলাফলও যে মানুষের জীবনে কত বাস্তব, এর একটা ছোট্ট উদাহরণ মায়মুনা নামে আনারকলির ছোটবেলার বান্ধবীর জীবন। সে সময় গ্রামে ভোরবেলা ছোট ছোট মেয়েরা প্রতিযোগিতা করে ফুল কুড়াতে যেত। এমন এক ভোরে মায়মুনা একা একা ফুল কুড়াতে যেয়ে দেখল আরও তিনটি মেয়ে। সমবয়সী মেয়ে তিনজনকে সে চেনে না। গ্রামের বাড়িতে ভোররাতে অপরিচিত তিন মেয়ের ফুল কুড়াতে আসার কথা না। সে আরও কি দেখেছিল বলা নেই গল্পে শুধু একটি আবহ তৈরি করেছেন পাঠকের জন্য লেখক। মায়মুনা প্রথমে অচেতন হয়, এরপর মারা যায়। মায়মুনার গল্প উপন্যাসের শুরুতে এখানেই শেষ হলেও পুরো বই জুড়েই আচ্ছন্ন করে রাখে বিভিন্ন নারীর সাথে অতি প্রাকৃত ঘটনার অনুভব। কেউ বিশ^াস করে সে অতিপ্রাকৃতের উপস্থিতিতে, কেউ সংশয়ে।
আনারকলি স্বল্পভাষী, পড়ালেখায় উৎসাহী একটি মেয়ে যে দাদা-দাদির স্নেহে বড় হচ্ছে। বাবা মঈনুদ্দিনের সাথে সবকিছুতে মতে মিললেও জীবনে প্রভাব বেশি তাঁর মা আর দাদাজানের। বাবার সঙ্গে উত্তম সুচিত্রার সিনেমা দেখতে যাওয়া, নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছা বাবার সঙ্গে শেয়ার করাসহ বাবা-মেয়ের মিষ্টি সম্পর্কের কিছু খন্ডচিত্র রূপায়িত হয়েছে লেখকের বর্ণনায়। মঈনুদ্দিন সংসারের কর্তা ব্যক্তি হলেও তার স্ত্রী’র কথাই শেষ পর্যন্ত ঠিক থাকে এমন বর্ণনার মধ্যে দিয়ে লেখক চিরাচরিত পুরুষ শাসণের প্রথার বাইরে আরেকটু ভিন্ন দৃশ্য দেখিয়েছেন ষাট দশকের একটি গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারে।
উপন্যাস ব্যক্তি চরিত্র থেকে বিস্তার পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজনৈতিক সংকটের ব্যক্তি জীবনের প্রভাবের ভেতর দিয়ে। অসুস্থ সিলভিকে নিয়ে বাবা-মায়ের নাজেহাল অবস্থা, পালিয়ে গ্রামে চলে যাওয়ার বর্ণনায় মানুষের অসহায়তার গল্প।
দুই নারীই যখন তাদের গল্প বলে যাচ্ছে তখন কখনো নাম কখনো উত্তম পুরুষ কখনো দ্বিতীয় ব্যক্তির বর্ণনায় পাঠক ধাঁধায় পড়তে পারেন। মিকাঈলের উপস্থিতির আরও বিশদ বর্ণনা প্রয়োজন ছিল বলে মনে করি। ২২ আঙ্গুলের জীবন’ শাহনাজ মুন্নীর প্রথম উপন্যাস। সহজ ভঙগীতে তিনি এঁকেছেন কয়েকটি চরিত্রের গোপন ও প্রকাশ্য জীবনের মর্মগাঁথা। ১৫৬ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসে পাঠক পাবেন নারীর চোখে দেখা পরিবর্তিত সময়ের গল্প। হেমন্ত থেকে বসন্ত আসার কথা। আবার সে সময়কে অনুভব করতে না করতেই জীবনের চলে যাচ্ছে পরবর্তী পৃষ্ঠায়। প্রকৃত অর্থেই মানুষ জানে না নিজের ভবিষ্যত। তাঁর শিক্ষা, সংস্কার বা বিশ^াস-অবিশ^াস ভবিষ্যতের অনেককিছুর নিশ্চয়তা দিলেও অনির্ধারিত থেকে যায় প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্ক। শুধু রাজনৈতিক ভাষ্য নয়, শুধু প্রেম নয় বা সমাজ সংস্কার, পরিবেশ সচেতনতা নয়, শাহনাজ মুন্নীর বাইশ আঙ্গুলের জীবন উপন্যাসটি প্রচলিত বিষয় থেকে বেশ খানিকটা ভিন্ন মেজাজে লেখা। বিশ্বাস অবিশ্বাসের যাত্রায় বাস্তবতা আর অতিপ্রাকৃতের সাথে মানুষের সম্পর্কের এক রহস্যময় আকর্ষণীয় উপাখ্যান ।