‘তমোহর’ আত্মঘাতী সময়ের দিনলিপি :: শাহনাজ নাসরীন

‘তমোহর’ আত্মঘাতী সময়ের দিনলিপি :: শাহনাজ নাসরীন

কবিতাগ্রন্থটির নাম তমোহর। পঁয়ত্রিশটি ভিন্ন স্বাদের কবিতা নিয়ে বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে ফেব্রæয়ারি ২০১৮ তে প্রকাশিত কবি রুবী রহমানের কাব্যগ্রন্থ ‘তমোহর’কে বলা যায়Ñ অমারাত্রির হিসাব-নিকাশ এক আত্মঘাতী সময়ের দিনলিপি। তমো/তমা হরণ করে যে সে তো সুর্য। তমসাচ্ছন্ন এই দেশে কবি রুবী রহমান কি তবে সুর্যকে ডাকছেন অন্ধকার সরিয়ে আলোর উদ্ভাসন ঘটাতে? যেমন সুকান্ত ডেকেছিলেন শীতের সুর্যকে একটু উষ্ণতার জন্য? তমোহর অজ্ঞানতা নাশকও। অজ্ঞানতার অন্ধকার সে যে প্রকৃতির অন্ধকারের চেয়ে লক্ষগুন প্রবল! তমোহরকে ডাকা ছাড়া আর কীইবা করার থাকে একজন অসহায় কবির যখন কিনা তার চারপাশে লেলিহান লোভ, লোভজাত তীব্র ঈর্ষা আর জীবন ধ্বংশকারী ভয়াবহ ঘৃণা ডেকে আনছে নৃশংস মৃত্যু, মৃত্যুর উল্লাস! কেউ সুর্য হয়ে উঠতে পারে না এখানে বরং কীটানুকীটদের লোভ লকলকে জিভ, হিং¯্র থাবা কেড়ে নেয় সুর্যসম প্রিয়জন।
কবি রুবী রহমান লিখছেন সেই শৈশব থেকে। ১৯৮২তে কবি বন্ধুদের সাথে প্রকাশিত হয়েছিল যুগলবন্দি গ্রন্থ ভালোবাসার কবিতা, তারপর ১৯৯১ এ যে জীবন ফরিঙের, ২০০৬ এ কান পেতে আছি, মৌমাছি আর ২০১৮ তে তমোহর। ২০০৪ এ অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার এবং ২০১০ এ বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত কবিতার একনিষ্ঠ প্রেমিক স্বনামধণ্য এই কবিকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবার কিছু নেই। তবু তার বইএর সংখ্যা বিবেচনায় নিলে বিদুষী খনা বা কবি চন্দ্রাবতীর মতো আরো এক শক্তিশালী নারী কবির কবি জীবনের অপচয় অনুধাবন করা কঠিন হয় না
বইটি কবি উৎসর্গ করেছেন তার ছেলে ও মেয়েকে। তমোহর কবির একমাত্র ছেলের নাম। প্রথম সন্তানকে ঘিরে কবির নিশ্চয়ই স্বপ্ন ছিল সে আলোকিত মানুষ হবে এবং আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগরও হবে। তাই তার নাম তমোহর। লিখেছেনও,
তমোহর তুই করবি এ দেশে তমসা হরণ
তাই এসেছিলে। মৃত্যুঞ্জয় হোস। কোনোমতে ভুলিস না পণ।
জ্ঞানপাপীদেও হিংসা-দ্বেষের অবসান হোক। তাই যে
তমোহর, তোর গিটার আজকে সত্যের গান গাইছে।
(তমোহরের জন্মদিন পৃ:৩১)

সেই সন্তান বলী হয়েছে ঘোর অন্ধতার, বিবেকহীনতার! শুধু সন্তান নয় একই সঙ্গে জীবনসঙ্গীকেও হারিয়েছেন একই লালসার আগুনে এবং শুধু তারাই নয় আরও অনেক অনেক সুর্যসন্তান হুমায়ুন আজাদ, অভিজিৎ, দীপণ, রাজিব যারাই আলো ছড়াতে চেয়েছে তাদেরকেই প্রাণ দিতে হয়েছে বার বার। কবি তাঁর প্রিয়জনের পাশাপাশি তাঁদেরও স্মরণ করেন সমযন্ত্রণায়। তমোহর তাই শুধু কবির সন্তান থাকে না ভিন্ন এক ব্যঞ্জনায় আত্মকেন্দ্রিক সমাজ মানসের অন্ধত্ব নিবারক হয়ে আসে।
আমার নাড়ি-ছেঁড়া ধন পুচির মৃত্যুযন্ত্রণা
আমি দেখিনি
আমার স্বামী শেষ নিঃশ^াস ফেলবার সময়ও
আমি ছিলাম না তাঁর পাশে।
কিন্তু আমি শুনেছি অভিজিতের মৃত্যুচিৎকার
বসন্ত-বাতার আজও ভারী হয়ে আছে
অভিজিতের স্ত্রীর হাহাকারে
হুমায়ুন আজাদেও মেয়ের কান্নায়।
(পৃথিবী-কাঁপানো চিৎকার; পৃ:১১)
জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে বিপর্যস্ত এক পরিস্থিতিতে কবি রুবী রহমানের বোবা কান্না চিৎকার হয়ে বেরিয়ে আসতে চায়, পৃথিবী কাঁপিয়ে দেবে যে চিৎকার! সে চিৎকার শুরু হলে আর থামবে না বলে সাবধান করেন কবি।

পাছে আমিÑ
পাছে আমি এইসব দেখেশুনে,
সমাজ-সংসারে চোখ রেখে
সেই আকাশ-ফাটানো চিৎকারটা দিয়ে ফেলি
তখন তো মুখ চেপে ধরেও থামানো যাবে না
সেই পৃথিবী-কাঁপানো চিৎকার!
(পৃথিবী-কাঁপানো চিৎকার; পৃ:১১)

তবু এই চিৎকারটি তিনি থামিয়ে রাখেন সর্বংসহা ধরণীর মতো। নিজেকে ভুলিয়ে রাখতে চেষ্টা করেন, ব্যঙ্গ করে বলেন,
‘আজকাল আমি খুবই যতœ-আত্তি করছি আমাকে।
প্রায়ই আইসক্রিম কিনে দেই
কেক-পেস্ট্রি খাওয়াই;
বড়সড় ভুল করে বসলেও মোটেই বকাঝকা করি না’
(পৃথিবী-কাঁপানো চিৎকার; পৃ:১১)

অনেক দেখেছেন জীবন। তাই কখনও পরিহাস করেন নিজেকে নিয়েই। যতই পরিহাস হোক বা ব্যঙ্গ, সমাজ সচেতন কবি তার মাঝেই জানিয়ে দিচ্ছেন জীবনকে আমরা কোনরকমে তালি-তাপ্পি মেরে চালিয়ে নিই। জীবনের দৈনন্দিনতার চাপে স্বপ্ন, ভালোবাসা, নান্দনিকতা আমাদের জীবন থেকে দৌঁড়ে পালায়। জীবনকে বয়ে নিতে নাভিশ^াস ওঠে আমাদের।
অনাহারে অর্ধাহারে মরে তো গিয়েছি কবে
দু চামচ স্বপ্ন দাও
খেয়ে বেঁচে উঠি
(দু চামচ শব্দ দাও, পৃ: ১৮)
কিংবা,
আপনারা নিশ্চয় ধরে ফেলেছেন
জীবনের মতই তালি-তাপ্পি-দেয়া এই কবিতা।
এর দুটো লাইন লেখা হয়েছিল অঘ্রান মাসে
তার ওপর দিয়ে বয়ে গেল কত সিডর, কত বসন্ত!
মাছের দরদাম করতে করতে
আর দুটো লাইন টুকে রেখেছিলাম টাকার উল্টোপিঠে।
তারপর এলো মুদ্রাস্ফীতি, এলো দুর্ভিক্ষ
কোথায় উড়ে গেল টাকা
উড়ে গেল অবিশ^াস্য বাস্তব
তার পিছনে সমুদয় অসংবৃত স্বপ্ন।
(তাপ্পি-মারা কবিতা, পৃ: ১)

নিজেকে সান্ত¡না দিতেই হয়তো কবি স্মরণ করেন ঐতিহ্য আর গৌরব গাঁথা। স্বাধিকার আন্দোলন, ভাষার জন্য লড়াইÑএকুশে ফেব্রæয়ারি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, টাঙ্গাইলের তাঁতি, চৈত্রসংক্রান্তি, শান্তিনিকেতন এমনি আরও অনেক আলোড়ন, আনন্দ-বিষাদ-ভালোবাসা। কিন্তু গর্ববোধের পাশাপাশি দাড়িয়ে থাকে পরাজয়ের যাতনা, আশায় বুক বাঁধতে চেয়েও লুটিয়ে পড়তে হয় হতাশায়। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে তরুণেরা স্বাধীনতা তো ছিনিয়ে এনেছে কিন্তু তারপর? তারপর কী হলো?

এই ভাঙা মনে শুশ্রƒষা দেবে, তোমার মতন ¯েœহে ভাস্বর
কে রয়েছে আজ? তরুণ মনকে ফেরাবে আবার বইয়ের পাতায়।
অস্ত্রের মোহ ভুলে চাষি হয়ে প্রাণ ভরে নেবে মাটির মায়ায়।
তরুণ হৃদয়ে কে দেখাবে পথ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর!
(বজ্রকন্ঠে তোমার ভাষণ পৃ:১৩)

অথবা

রাজপথে লাল রক্ত ঢেলেছিল বাংলার তেজোদৃপ্ত সাহসী তরুণ
সেই কথা মনে রেখে
গাছে গাছে সহ¯্র রক্তিম ফুল ফোটায় ফালগুন।

নিসর্গের নিয়মেই আমরা বাঁচি মরি
শিশুর মাথায় তবু না ফুটিয়ে গোলাপ মঞ্জরি
আমরা তার করোটিতে ঢালছি সেঁকো বিষ
আর নাকে তেল দিয়ে ফাঁকা বুলি গাইছি অহর্নিশ!
(শিশু আর ফেব্রæয়ারি পৃ:৪৭)

এই প্রেমহীনতা, অজ্ঞানতা, অন্ধতা কবিকে বেদনাক্রান্ত করে। অপনোদনের জন্যই হয়তো শোকগ্রস্থ কবি জননী সাহসিকাকে খুব বেশি করে মনে করেছিলেন। ছুটে যেতে চেয়েছিলেন তার কাছে বলিষ্ঠতার পাঠ নিতে, সহিষ্ণু বৃক্ষের মতো অটল থাকার পাঠ নিতে। বলেছিলেন,
আপনি নেই কেন আজকে?
কার কাছে হাপুস নয়নে বসে কাঁদি!
কে আমার চোখ ভরা পানি দেখে বলবে না
‘তোমাকে শক্ত হতে হবে’

অমন বলিষ্ঠ স্বরে, অমন নির্ভয়ে
আপনার মতো করে কে বলবে ‘এ ঘোর অন্যায়’

আপনি আজ নেই কেন, কার কাছে শিখব বলুন
কী করে বৃক্ষের মতো, অটল বৃক্ষের মতো
মাথার উপরে তীব্র বজ্রপাত
দিগন্তে ছড়িয়ে দেয়া যায়।
(কবি সুফিয়া কামালের জন্মদিনে পৃ:৪৩)

প্রশ্ন জাগে কেন এত মেনে নেয়া? কেন অপরাধীদের মঞ্চ আলোকিত করে বসে থাকতে দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কিছুই পারেন না? একজন কবি বিদ্রোহ না করে প্রতিবাদী না হয়ে কেন বলেন,

কী মেনে নিইনি!
যেদিন আমার নিজের ঘর-সংসার নিখিল ভুবনে
ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়া হলো
সেদিনও টু শব্দটি করিনি।
(মেনে নেওয়া পৃ:৩৭)
এমনকি নিজের অস্তিত্ব বিপন্ন হলেও মেনে নেয়া ছাড়া কিছুই বলার থাকবে না বলছেন যখন তখন পাঠক হিসেবে আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয় এত সহিষ্ণুতা আপনার সাজে না কবি। ’মাথার ওপর তীব্র বজ্রপাত’ নিয়ে অটল হয়ে থাকা চাই না। নাকি এ অভিমান! ‘হাত ফসকে জীবনটা অথই সমুদ্রের জলে’ তলিয়ে যাওয়ার অভিমান? পাথর সময়ের কাছে, ধূসর ঊষরতর বিচারের কাছে এক জীবন্মৃতের কীইবা প্রত্যাশা থাকে! অথচ কত প্রেম ছিল তার জীবনের প্রতি! থই থই জোছনায় বারান্দায় ছুটে গেছেন উনুনে ভাতের হাঁড়ি চাপিয়ে। চাঁদ, নক্ষত্র আর রূপালি জড়ি পাড়ের কোমল অনল তাকে পুড়িয়েছে তীব্র ভাসিয়ে নিয়ে গেছে আকাশ থেকে আকাশে, করোটিতে বাজিয়েছে সুমিষ্ট বাঁশি! শান্তিনিকেতনে ফুলের বন্যায় পাতার মর্মরে,গানের বিভোরতায় বুঁদ হয়েছেন। এক সুখের মাঝে তারপর আবার উঁকি দিয়ে যায় দুঃখÑ নীলমণি লতাটির মুখোমুখি বসে বুঝে নেই/ আজকাল তুমি ছবি। তুমি শুধু নাম।

প্রতিটি কবিতায় ক্ষণে ক্ষণে ‘দুঃখ তার লেখে নাম’। বার বার প্রিয়জনদের কাছে ফিরে যান কবি। একটি হোন্ডার গল্প শোনানোর ছলে জীবনসঙ্গীর সাথে স্মৃতিময় দিনের কথপোকথন। কী চমৎকার সেইসব দিন! সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশে একটি মোটর সাইকেল কিনেছেন তার প্রিয়তম আর তাতে চড়ে কবি নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ান (‘হেন জায়গা নেই যেখানে এই গুঞ্জরনশীল বাহনটি নিয়ে যায়নি আমাকে।’) এর ফাঁকে মজা করে মধ্যবিত্ত জীবনের টানাপোঁড়েনও নিয়ে আসেন বেশÑ
কিন্তু হৃদয়ের উষ্ণতায় তো সংসার চলে না
পুরোনো হোন্ডা যখন রাস্তায় বিকল হয়ে যেত
খুব কষ্ট হতো তোমার।
অন্ধকার রাতে অচেনা রাস্তায় নানা কসরত করেও
যখন সচল করা যেত না হোন্ডাটিকে
তখন তোমার হতাশা-মলিন মুখের দিকে
তাকানো যেত না।

কবি জানাচ্ছেন রাস্তা ছিল ছিনতাই কন্টকিত আর ঘুটঘুটে অন্ধকারাচ্ছন্ন। অথচ অনিরাপদ সেই রাস্তায় গলদঘর্ম প্রিয়তমের পাশে দাড়িয়ে এক প্রিয়তমা শুধু পুরো মাসের তেল নুনের হিসেব কষতে কষতে ভাবতেন কবে একটি নতুন হোন্ডা কিনতে পারবেন প্রিয়তমের জন্য। এরপরের ছত্র ‘গিফট অব দ্য মেজাই’ এর চেয়েও নির্মম, করুণ। গভীর বেদনায় কবির উচ্চারনÑ
এখন আমার চলাফেরা করবার জন্য
একটি গাড়ি হয়েছে
আর তুমি চলে গেলে সবুজ ঘাসের ভিড়ে।
(একটি হোন্ডার গল্প পৃ:৪৫)

জীবনের অতল গভীর থেকে উঠে আসা এইসব পংক্তিমালা পাঠককে গভীর বিষাদাক্রান্ত করলেও সত্যপাঠের চেতনায় সে জেগে উঠে। শোক-ব্যাথা-ক্ষোভ বুকে চেপে কবির পাশে দাড়িয়ে শপথ নেয়Ñ
পুত্রশোক ভুলে
আজ আমি দাড়ালাম তবে
অশ্রæজলে আর ইতিহাস লেখা নয়Ñ
জীবনের জয়গান হবে।
(আজ আমি দাড়ালাম পৃ:৪০)

Leave a Reply